রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২৩ অপরাহ্ন
বরগুনা সংবাদদাতা॥ রিফাত হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ১ নং আসামী সাব্বির আহমেদ নয়ন নয়ন বন্ড পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার দিবাগত ভোর রাত চাররটার দিকে সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের পুরাকাটা এলাকার পায়রা নদী সংলগ্ন চরে তার মরদেহ পাওয়া যায়। নয়ন ঘটনার পর থেকে পলাতক ছিলেন।
নয়ন নিহত হওয়ার পর বরগুনা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়েজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন নয়ন নিহত হওয়ার ঘটনার বিবরণ দেন। তিনি বলেন, নয়ন বন্ড ও তার কিছু সহযোগী সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের পুরাকাটা ফেরীঘাট থেকে উত্তর দিকে মজিদ মিলিটারি বাড়ির কাছাকাছি অবস্থান করছে আমাদের কাছে এমন খবর আসে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পাথরঘাটা সার্কেল বিএম আশ্রাফ উল্যাহ তাহেরের নেতৃত্বে বরগুনা থানা পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। টের পেয়ে আসামীরা পুলিশকে লক্ষ করে গুলি ছোঁড়ে। জবাবে পুলিশ পাল্টা গুলি ছুরতে থাকলে এক পর্যায়ে আসামীরা পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে এক ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ মরদেহ থাকতে দেখা যায়। পরে স্থানীয়রা ওই ব্যক্তিকে নয়ন বন্ড হিসেবে সনাক্ত করেন।
অভিযানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর সার্কেল মোঃ শাহাজাহান, বরগুনা থানার এসআই হাবিবুর রহমান ডিবির এসআই মনিরুজ্জামান ও কনস্টেবল হাবিবুর রহমান আহত হন। এদের মধ্যে মো. শাহজাহান হোসেন ও হাবিবুর রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশালে পাঠানো হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে তিনটি চাপাতি, একটি পিস্তল ও তিন রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। নয়ন বন্ডের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য বরগুনা জেলা হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।
নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে নিহত এমন খবর ছড়িয়ে পরলে উৎসুক জনতা ভোর থেকেই ওই এলাকায় ভিড় জমায়। উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসা হলে শত শত মানুষ থানার বাইরে দাড়িয়ে নয়নের মরদেহ দেখতে আসে।
আলোচিত রিফাত হত্যার ১নং আসামী সাব্বির হোসেন নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের খবরে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দীকা মিন্নি। মিন্নি বলেন, আমি এখন স্বস্বিতে নিঃশ্বাস নিতে পারছি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহীনির প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমি ধন্যবাদ জানাই। বাকি আসামীদেরও যাতে দ্রুত গ্রেফতার করা হয় ও সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়ার দাবি জানাই’।
মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বলেন, আমরা মনের দিক থেকে অত্যন্ত আনন্দিত ও খুশি। আমি মনে করি আমরা নয়ননের বিচার পেয়েছি। আর যেন কোনো মায়ের কোল এভাবে খালি না হয়, কোনো স্ত্রীকে এভাবে স্বামী হারাতে না হয়। বাকি আসামীদেরও যাতে গ্রেফতার করে দৃষ্টামূলক শাস্তিদেয়া হয় এমন দাবি করে কিশোর বলেন, এ ঘটনা দেশে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
নিহতের বাবা দুলাল শরীফ কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ছেলেকে তো ফিরে পাবোনা, তবে ছেলের আত্মা অন্তত একটু হলেও শান্তি পাবে। আমার একমাত্র ছেলেকে আমি যাদের কারণে হারিয়েছি, তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দেখে যেতে চাই। আমি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই, পাশাপাশি মাননীয় প্রধামন্ত্রীর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা, তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামীদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমার ছেলে রিফাত ও আমাদের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া প্রার্থনা করছি। আমি আশা করি বাকিদেরও দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।
উল্লেখ্য গত ২৬ জুন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের মূল ফটকের সামনের রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম করা হয় রিফাত শরীফকে। এ সময় বরগুনা সরকারি কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্রী আয়েশা সিদ্দীকা মিন্নি তার স্বামীকে রক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালান। কিন্তু সন্ত্রাসীরা তাকে (রিফাত) উপর্যুপরি কুপিয়ে গুরুতর জখম করে পালিয়ে যায়। পরে ওইদিন বিকেল ৩টার দিকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে রিফাত শরীফের মৃত্যু হয়। জনবহুল এলাকায় এমন নৃশংস হামলার ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে দেশেজুড়ে বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভের ঝড় ওঠে।
ঘটনার পরদিন অর্থাৎ ২৭ জুন সকালে নিহত রিফাতের বাবা বরগুনা সদরের বড় লবণগোলার বাসিন্দা আবদুল হালিম শরীফ বাদী হয়ে বরগুনা সদর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় বরগুনা শহরে চিহ্নিত সন্ত্রাসী সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড এবং তার সহযোগী রিফাত ফরাজী ও তার ছোট ভাই রিশান ফরাজীসহ ১২ জনকে আসামি এবং আরও চার থেকে পাঁচজনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়।এ মামলায় সোমবার পর্যন্ত নয়জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে চন্দন (২১), মো. হাসান (১৯), অল্লিাউাহ (২২) টিকটক হৃদয় (২১) এজাহারভুক্ত আসামি। ঘটনার পরের দিন সকালে চন্দনকে, সন্ধ্যার মো. হাসান গ্রেফতার করা হয়। রোববার বরগুনা থেকে অলিউল্লাহ (২২) এবং ঢাকা থেকে টিকটক হৃদয়কে (২১) গ্রেফতার করে পুলিশ। অন্য পাঁচজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন নাজমুল ইসলাম (১৮), সাগর (১৯), তানভিড় (২২), কামরুল হাসান ওরফে সাইমুন (২১)। অপর একজনের নাম পুলিশ প্রকাশ করেনি।এর মধ্যে সোমবার (১ জুলাই) বিকেলে এই মামলায় গ্রেপ্তার দুই আসামি অলি উল্ল্যাহ ওরফে অলি ও তানভিড় হোসেন ১৬৪ ধারায় বরগুনার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ওইদিন বিকেলে বরগুনার বিচারিক হাকিম সিরাজুল ইসলাম গাজীর আদালতে ওই দুই আসামিকে উপস্থিত করে তাদের দুজনের এই জবানবন্দি নেওয়া হয়। অলিউলাহ রিফাত হত্যা মামলার ১১ নম্বর আসামি; তাকে রোববার গ্রেফতার হয়। আর তানভিড় সন্দেহভাজন আসামি। সে মূল আসামি নয়ন বন্ডের সন্ত্রাসী দল ‘০০৭’ এর সক্রিয় সদস্য। তবে মামলা প্রধান আসামি নয়ন বন্ড ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হলেও প্রধান অপর দুই আসামি রিফাত ফরাজী ও তার ছোট ভাই রিশান ফরাজী এখনও পলাতক। আর পুলিশ রিমান্ডে রয়েছেন আসামি নাজমুল হাসান, সাগর ও সাইমুন।
পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বলেন, বাকি আসামীরা পুলিশের জালে আবদ্ধ আছে। খুব শিগগিরই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। আসামীদের গ্রেফতার সার্বিক সহযোগীতাকারীদের তিনি ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, সর্বস্তরের মানুষ বিশেষ করে গণমাধ্যমকর্মীরা পুলিশকে যে সহায়তা দিয়েছে তা সত্যি প্রসশংনীয়।
Leave a Reply